গত ৩০ জুন অনুষ্ঠিত হল কিচেনার-ওয়াটারলু 'র বাংলাদেশীদের বাৎসরিক বনভোজন । এবারের স্পট ছিল গ্রান্ড রিভার কনজারভেশন অথরিটির সংরক্ষিত এলাকা Elora Gorge (সঠিক উচ্চারণ এলোরা গর্জ; জর্জ নয়।) ইংরেজি শব্দ গর্জ এর বাংলা অর্থ গিরিখাত। দুই ধারে উঁচু পাড় আর মাঝখানে বয়ে চলা অগভীর স্রোতস্বীনি, নাম না জানা হরেক রকমের আকাশছোঁয়া গাছপালা, ভেতরে গাড়ি চলাচলের রাস্তা-- কখনো ঢালু আবার কখনো উঁচু, সুবিশাল খেলার মাঠ, সুবিন্যস্ত ক্যাম্প সাইট, অত্যন্ত সাজানো গোছানো এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এক বিনোদন কেন্দ্র এলোরা গর্জ।
প্রতিবারের মত লাভলি ভাবী এবং ফারুক ভাই ছিলেন সার্বিক ব্যবস্থাপনায়। পিকনিকের ঘোষণা আসে চিরায়ত সেই মেইলিং লিস্টে। আগ্রহীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য দায়িত্বে ছিলেন সুমি ভাবি আর নাহিদ ভাবি। ২২ জুনের মধ্যেই আগ্রহীদের তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে বলা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক। জাহিনের ইমেইলে এলো স্পট সম্পর্কে বিস্তারিত, সাথে গুগলের ম্যাপ আর আ্যডমিশন ফি সংক্রান্ত কিছু তথ্য। যেহেতু আমাদের গ্রুপটি প্রায় আশি জনের তাই আ্যডমিশন ফি তে ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে। ঠিক হল ৩০ তারিখ সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই সিগরাম ড্রাইভ পার্কিং লটে সবাই একত্রিত হবে। অবশ্য ইচ্ছে করলে কেউ সরাসরিও পিকনিক স্পটে চলে যেতে পারে। গতবারের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারে সময়ের ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিলেন। তাই ঠিক সোয়া দশটায় যাত্রা হয় শুরু। গন্তব্য বেশী দূর নয়। আধা ঘন্টার পথ।
আমি, রিফাত আর আমাদের মেয়ে অহনা একটু দেরি করেই বের হই। পাপিয়াকে তার বাসা থেকে নিয়ে প্রায় সাড়ে দশটার দিকে রওনা দেই। খানিক পরেই শহরের বাইরে। দুই পাশে ভুট্টার ক্ষেত। তার মাঝ দিয়ে আঁকা বাঁকা পিচঢালা পথ চলে গিয়েছে। গ্রীষ্মের এক চমৎকার সকাল। পরিস্কার নীল আকাশে থোকা থোকা সাদা মেঘের পুঞ্জ আর তার সাথে সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। এলোমেলো বাতাস বইছে থেমে থেমে। এখানে ধান ক্ষেত নেই। দিগন্তবিস্তৃত ভুট্টার ক্ষেতে দামাল ছেলের মত বাতাস নেচে বেড়ায় না। দূরে একসারি গরু চরে বেড়াচ্ছে। রাখালের দেখা নেই। উঁচু-নিচু এই পথ যেন বয়ে চলেছে অন্তহীন গন্তব্যে। একসময় এলোরা গর্জ-এ পৌঁছুলাম।
এরই মধ্যে প্রায় সবাই উপস্থিত। একটু পরে শরিফ ভাই এলেন। প্রতিটি পিকনিকেই শরিফ ভাই একটা না একটা মজার ঘটনা ঘটান। এবারও ব্যতিক্রম নয়। তিনি গাড়ি চালু অবস্থাতেই চাবি ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। এদিকে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছ । বাশার ভাই স্কোর করছেন। ইসমাইল ভাই আর আদনান ভাই দুই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পাড়া-মহল্লার অনেক নামী-দামী খেলোয়াড়রা খেলছে। আদনান ভাই তার ডিপার্টমেন্টের অপরিহার্য প্লেয়ার। জাহিন নাকি আগে খ্যাপে খেলতে যেতো। এদের সাথে মুরসালিন ও শাহেদ স্যারের মত শখের খেলোয়াড়ও আছে। যা হোক আদনান ভাইয়ের দল পরে ব্যাট করে সহজেই জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রান সংগ্রহ করে নিল।
ইসমাইল ভাইয়ের প্রাণশক্তি মনে হয় অফুরন্ত। ক্রিকেট শেষ করেই শুরু করেছেন ফুটবল। মুস্তাক কোনদিন খেলেছে কি-না জানিনা। তাকেও দেখলাম ড্রিবলিং করছে। পাকা খেলোয়ার জুলহাস আর শরিফ ভাই। তাদের প্রচেষ্টায় গোল করে খেলায় ২-২ এ সমতা ফিরে এল।
মধ্য দুপুরে ঠিক হল গর্জ দেখতে যাব। কিন্তু লাভলি ভাবি বললেন খাওয়া দাওয়ার পরে প্রোগ্রাম শেষ করে তবে যেতে। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে ফার্গাসের এক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে। ফারুক ভাই, আলাউদ্দিন ভাই আর কয়েকজন গিয়েছেন আনতে। একটু দেরি হচ্ছে। এই ফাঁকে জোহরের নামাজ পড়ে নেয়া হল। তারপর খাওয়া পর্ব শুরু। চমৎকার রান্না। এখানে পিকনিক স্পটে 'পিকনিক টেবিল' থাকে। ফলে যে যার মত লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে টেবিলে বসে খাওয়া। খাবার টেবিলে চলে হরেক রকম আলোচনা-- দেশ, রাজনীতি, দিনকাল।
গ্রীষ্মে এখন সন্ধ্যা হয় সোয়া নয়টায়। খাওয়া শেষ হতে হতে সূর্য কিছুটা হেলে পড়েছে। শুরু হল মেয়েদের মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা। সবাই গোল হয়ে বসেছে আর জুলহাস এক হাতে চোখ ঢেকে মিউজিক নিয়ন্ত্রণ করছে। একে একে বাদ পড়ছেন ভাবিরা। আমার বৌও আউট। টিকে রইলেন তিনজন। তার মধ্যে আছে সাজু'র নবপরিণীতা বৌ। এক পর্যায়ে কিছুটা উত্তেজনা এল। এক ভাবি বাদ পড়েও বাধ সাধলেন উঠে যেতে। কী আর করা আবার মিউজিক বাজল। শেষ পর্যন্ত সেই ভাবিই জয় ছিনিয়ে নিলেন।
এবার হবে ছেলেদের ১০০ মিটার দৌড়। জাহিন সবাইকে জড়ো করার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে জনা দশেক লাইনে দাঁড়িয়েছে দৌড় শুরু হবে বলে। মুস্তাকও সেখানে। মুস্তাক পেছনে ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি দৌড়াব কি-না। এরই মধ্যে কে যেন ওয়ান-টু-থ্রি বলে দিয়েছে। শুরু হয়েছে দৌড়। শেষ পর্যন্ত যারা দৌড়ের আয়োজক- সেই জাহিন আর মুস্তাক ছাড়াই শেষ হল দৌড় প্রতিযোগিতা। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা।
শেষ বিকেলে যার যার মত গর্জ দেখতে বের হলাম। যেতে হবে আপস্ট্রীমে। সেখান থেকে টিউব নিয়ে ক্ষরস্রোতা পাথুরে পাহাড়ী নদী বেয়ে মানুষ ভেসে যায় ডাউনস্ট্রীমে। রাস্তা থেকে বিপদসংকুল পথ বেয়ে নেমে আসতে হয় অনেকখানি। বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে ধেয়ে আসছে স্রোত। অগভীর পথে তা পাথরে বাঁক খেয়ে দুধ-সাদা রং নিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হল। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে সোনালি আলোয় ঝলমল করছে সবুজ ক্ষেত। গরুগুলো তখনো চরে বেড়াচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে এল। শেষ হল একটি চমৎকার দিন।
লেখাটি যা নিয়ে: Elora Gorge, এলোরা গর্জ, গ্রান্ড রিভার, কনজারভেশন, বাংলাদেশ, পিকনিক, কানাডা, কিচেনার, ওয়াটারলু, কিচেনার-ওয়াটারলু।
No comments:
Post a Comment