2006/12/09

উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডা

বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডা আসার পর থেকে আমার কাছে অনেকেই বিভিন্ন সময় ইমেইল করে জানতে চেয়েছেন কানাডার শিক্ষা ব্যাবস্থা, এখানে উচ্চশিক্ষার (মাস্টার্স, পিএইচডি) সুযোগ, কিভাবে ভর্তি হওয়া যায়, ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট ইত্যাদি সম্পর্কে। যদিও কানাডার সব ইউনিভার্সিটির পরিপূর্ণ ওয়েবসাইট রয়েছে এবং সেখানে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ভর্তির রিকোয়ারমেন্টস ও পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমতঃ নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পেরেছি যে বাংলাদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থার সাথে উত্তর আমেরিকার (স্পেসিফিক্যালি কানাডা) শিক্ষাব্যবস্থার যে ফারাক তা সত্যিকার অর্থে অনুধাবন করা সহজ নয়। উচ্চশিক্ষার জন্য নর্থ আমেরিকা নিঃসন্দেহে সবার প্রথম পছন্দ। আমার মনে হয় এর কারণ মূলতঃ সাইকোলজিক্যাল। আমাদের অনেকেরই একটা ধারণা রয়েছে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় নর্থ আমেরিকানরাই এগিয়ে আছে;আর তাই আমাদের সবার পছন্দের তালিকায় আমেরিকা (ইউএসএ) কানাডাই রয়েছে সবার উপরে। এই ধারণা যে একেবারে অমূলক নয় তার ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। তবে কানাডায় উচ্চশিক্ষা করতে যারা ইচ্ছুক তাদের জন্য এই লেখাটি কাজে আসবে বলে মনে করি।

যারা এখনো স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি যে কোথায় উচ্চ শিক্ষার জন্য আ্যপ্লাই করবেন, তাদের প্রথমেই বোধকরি বলা প্রয়োজন কেন কানাডার আসার কথা আপনি চিন্তা করতে পারেন। যতগুলো কারণ মনে করা যেতে পারে তার মধ্যে ৯-১১ এর ঘটনা-পরবর্তী পরিবর্তিত বিশ্ব-পরিস্থিতির বিষয়টাকে আমি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে লেখাপড়ার জন্য আমেরিকার বিকল্প এখন এই কানাডা। কানাডা সত্যিকার অর্থেই মাল্টিকালচারাল দেশ। এ সত্যটি আমি কানাডায় তিন বছরের অভিজ্ঞতায় বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি। এখানে যে ব্যাপারটা অবাক করা হলেও সত্যি যে আপনার কখনোই মনে হবেনা আপনি একজন বিদেশী ছাত্র। প্রথম কানাডায় আসার আগে আমার একটা ভয় ছিল এ নিয়ে। এখানে এসে বরং এটিই বুঝেছি যে কানাডিয়ানরা আপনাকে মনে করবে ইমিগ্র্র্যান্ট এবং ডিস্কৃমিনেশন যতটা থাকবে বলে ভেবেছিলাম ততটা নয়। এর মূল কারণ হল কানাডা হচ্ছে ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যান্টস এবং এ ব্যাপারটি সার্বজনীন।

এবার আসা যাক কানাডায় উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়।

একাডেমিক সেশন
ভাবতে অবাক হলও সত্যি এখানে অধিকাংশ স্কুলে (এরা ইউনিভার্সিটিকে স্কুলও বলে) বছরে মাত্র ৮ মাস ক্লাস হয়। বাকী ৪ মাসই কোন ক্লাস হয়না অথবা বন্ধ থাকে। তবে অনেক ইউনিভার্সিটি রয়েছে যেখানে সারাবছরই কোন না কোন প্রোগ্রাম চালু আছে। এখানে একাডেমিক সেশন শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে এবং প্রতিটি সেমিস্টার হয় ৪ মাসের। মুলতঃ তিনটি সেমিস্টার বা সেশন রয়েছ– ফল (Fall) সেশন সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর, উইন্টার (Winter) জানুয়ারী থেকে এপ্রিল এবং স্প্রীং (Spring) বা গ্রীস্মকালীন (Summer) সেশন চলে মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত। যেহেতু ফল সেশনে একাডেমিক ইয়ার শুরু হয় সেহেতু ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ভর্তির সুযোগ এই সেশনেই সবচেয়ে বেশী। কিছু ইউনিভার্সিটি রয়েছে যারা তিন সেশনেই স্টুডেন্ট ভর্তি করে আবার অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিই কেবল ফল সেশনে ভর্তি করে। তবে ফাইন্যন্সিয়াল ডিসিশন ফল সেশনে নেয়া হয় বলে স্কলারশীপ এবং অন্যান্য বৃত্তির সুযোগ পেতে হলে এই সেশনের জন্যই বাংলাদেশে থেকে আ্যপ্লাই করা ভাল।

ইউনিভার্সিটি নির্বাচন
কানাডার অধিকাংশ ইউনিভার্সিটিই পাবলিক ইউনিভার্সিটি যেমনটা আমাদের দেশের ঢাকা ইউনিভার্সিটি, ইঞ্জিনয়ারিং ইউনিভার্সিটি, কৃষি ইউনিভার্সিটি। অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি চলে জনগনের টাকায়। তাই বলে টুইশান ফি আমাদের দেশের মত নয়। বাংলাদেশে পাবলিক ইউনিভার্সিটির মাসিক টুইশান ফি যেখানে মোবাইলে ৪ মিনিট কথা বলার খরচের সমান, এখানে টুইশান ফি’র কারণেই স্টুডেন্টদের একটা বড় অংশ ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। কানাডার ইউনিভার্সিটিগুলো নিজেরাই তাদের টুইশান ফি নির্ধারণ করে। টুইশান ফি ইউনিভার্সিটি ভেদে ফৃ (যেমন ইউনিভার্সিটি অব বৃটিশ কলাম্বিয়া) থেকে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার (যেমন ইউনিভার্সিটি আব ওয়াটারলু) পর্যন্ত রয়েছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯ লাখ টাকা। তবে যারা গ্রাজুয়েট লেভেলে (মাস্টার্স ও পিএইচডি) পড়তে চান তাদের এই খরচ নিয়ে চিন্তা না করলেও চলে । কারণ এখানে গ্রাজুয়েট স্টাডির খরচ ইউনিভার্সিটিগুলোই বহন করে। সাধারণত টিচিং আ্যসিস্টান্টশীপ বা রিসার্চ আ্যসিস্টান্টশীপ এর মাধ্যমে এই টাকা স্টুডেন্টরা পেয়ে থাকে।

বাংলাদেশ থেকে আ্যপ্লাই করার সময় অনেকেরই ইচ্ছা থাকে সবচেয়ে ভাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার। তবে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে যত ভাল ইউনিভার্সিটি তত কঠিন সেখানকার পড়াশুনা এবং ততোধিক প্রতিযোগীতামূলক সেখানকার ভর্তির প্রকৃয়া। তাই ভাল ইউনিভার্সিটির সাথে সাথে অপেক্ষাকৃত কম ভাল ইউনিভার্সিটিতেও আ্যপ্লাই করা উচিৎ। ভাল হয় যদি পরিচিত কেউ (যেমন সিনিয়র ভাইবোন) পাওয়া যায়। তার সাথে যোগাযোগ করলে সেই ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। অনেক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোন প্রফেসরের সাথে যোগাযোগের দরকার হয়না। আবার অনেক ডিপার্টমেন্ট আছে যেখানে প্রফেসরই ফান্ড দেয়। তাই পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ করে প্রফেসরদের নিজেদের ফান্ডের অবস্থা সম্পর্কে আগেভাগে জানতে পারলে সে মোতাবেক আ্যপ্লাই করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ভর্তির জন্য যা যা প্রয়োজন
মাস্টার্স লেভেলে ভর্তির জন্য বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের ১৬ বছরের শিক্ষা অভিজ্ঞতা দরকার। সে অর্থে ইন্টারমিডিয়েট+ ৪ বছরমেয়াদী অনার্স থাকাই যথেষ্ট। অনেক ইউনিভার্সিটিতেই ল্যাংগুয়েজ প্রফিসিয়েন্সি পরীক্ষা যেমন টোফল / আই ই এল টি এস বাধ্যতামূলক। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এ নিয়ম তারা শিথিল করে থাকে। কানাডায় দুই একটি বাদে কোন ইউনিভার্সিটিতেই জি আর ই স্কোর প্রয়োজন হয়না অর্থাৎ জি আর ই’র স্কোর তারা বিবেচনা করেনা।

আর একটি দরকারী জিনিস হল রেকমেন্ডশন লেটার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই সব রেকমেন্ডশন লেটার পড়ে। রেকমেন্ডশন লেটার হল আপনার একাডেমিক এবং গবেষণা করার যোগ্যতা মূল্যায়ন সম্পর্কিত একটি পত্র যা সাধারণত আপনার কাজের সাথে পরিচিত প্রফেসর দিতে পারেন। এর জন্য ইউনিভার্সিটিগুলোর নিজস্ব ফরম রয়েছে। তবে তার সাথে প্রফেসরদের লেটারহেড-এ আলাদা করে একটি চিঠি পাঠানো ভাল। সাধারণত ২-৩টি লেটার দরকার হয়। ভাল রেকমেন্ডশন লেটার না হলে ভর্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

অনেক সময় আ্যপ্লিকেশন প্যাকেজে Statement of interest বা Plan of study লিখতে হয়। এটি মাস্টার্স লেভেল-এর জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পি এইচ ডি’র জন্য খুবই দরকারী। আপনি মাস্টার্স আ্যপ্লিক্যান্ট হলে তারা দেখতে চায় আপনার রিসার্চ ইন্টারেস্ট কোনদিকে। কোন স্পেসিফিক একটা এরিয়াতে ফোকাস না করে কয়েকটি এরিয়াতে ইন্টারেস্ট দেখানো আমার মনে হয় ভাল। তবে সেক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরদের ওয়েবসাইট দেখে সে মোতাবেক একটা প্ল্যান তৈরী করা উচিৎ।

আ্যপ্লাই করার শেষ সময় ইউনিভার্সিটিভেদে আলাদা হয়। তবে সাধারণত ফল সেশনের জন্য সেই বছরের জানুয়ারী বা কোন কোন ক্ষেত্রে আগের বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সব ডকুমেন্ট নির্ধারিত ঠিকানায় পাঠাতে হয়। যেমন আপনি যদি ২০০৭ এর ফল এ ভর্তি হতে চান তাহলে ২০০৭ এর জানুয়ারী বা এ বছরের (২০০৬) ডিসেম্বর নাগাদ আপনার আ্যপ্লিকেশন ফরমস, ফি, ল্যাংগুয়েজ স্কোর, রেকমেন্ডেশন লেটার ইত্যাদি পাঠাতে হবে। সাধারণত টোফল / আই ই এল টি এস এর স্কোর পেতে ১ থেকে দেড়মাস সময় লাগে। তাই আমার ব্যক্তিগত মত হল নভেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বরের শুরুর মধ্যে অবশ্যই এসব পরীক্ষা দিয়ে ফেলা উচিৎ।

অনেক সময় পোস্টাল ডেলিভারির ভুলের কারণে দরকারী কাগজপত্র সময়মত পৌঁছায় না বা হারিয়ে যায়। তাই আ্যপ্লাই করার পর ইউনিভার্সিটির সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হতে হবে যে তারা আপনার সম্পূর্ণ আ্যপ্লিকেশন হাতে পেয়েছে। তারা কিন্তু নিজেরা আপনাকে জানাবে না যে আপনার টোফল / আই ই এল টি এস স্কোর তারা পায়নি। সেক্ষেত্রে আপনার অসম্পূর্ণ আ্যপ্লিকেশন তারা বিবেচনা করবে না। অনেক সময় কাগজপত্র দেরীতে পৌঁছুলে তারা দেরীতেই আপনার ফাইল প্রসেস করে। তবে সেক্ষেত্রে স্কলারশীপ বা অন্যান্য ফান্ডিং পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না অথবা কমে যায়। আর স্কলারশীপ না দিতে পারলে আপনাকে ওরা আ্যডমিশনও দেবেনা তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।

শেষ কথা
কানাডায় পড়াশুনার মান ভাল হলেও এখানকার সবচেয়ে খারাপ দিক হল এর জলবায়ু। আমি অনেককেই দেখেছি যারা কানাডায় থাকতে চায়না শুধু এই কারণেই। শীতকালে তাপমাত্রা প্রদেশভেদে মাইনাস ৫০ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। আবার গরমকালে তাপমাত্রা হয় প্রায় ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনেকের মনে হতে পারে ৩৩ ডিগ্রি আর এমন কী, বাংলাদেশে তো এর চেয়ে বেশী । কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন এই ৩৩ ডিগ্রিই এখানে গায়ের চামড়া পুড়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। জলবায়ু যাই হোক, কানাডায় লিভিং সত্যিই নির্ঝঞ্জাট। ভাল এখানকার মানুষ, এখানকার পরিবেশ। নিরাপদ, সুন্দর জীবন যাপনের জন্যও কানাডা হতে পারে আপনার পরবর্তী হোম।

No comments:

Post a Comment