ইন্টারনেটে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার খবর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কেউ যদি মনে করেন মূল্যবৃদ্ধি সমস্যা কেবল বাংলাদেশেই তাহলে ভুল করবেন। দেশে আত্নীয়-সজন অনেকেরই ধারণা আমরা কতই না আরামে আছি এখানে। সবকিছুই রঙিন এই সব দেশে! গ্রোসারি করতে গিয়ে দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা মনে পড়ল। এইতো সেদিনও ৪ লিটার ফুলকৃম দূধ কিনলাম ৪.৪০ ডলার দিয়ে, এখন তা কিনছি ৫ ডলারে (১ কানাডিয় ডলার প্রায় ৬০ টাকার সমতুল্য) । শতকের হিসাবে যা প্রায় ১৪শতাংশ বৃদ্ধি। তেমনি বেড়েছে ডিমের দাম। বড় সাইজের এক ডজন ডিমের দাম ২.১০ থেকে দোকান ভেদে হয়েছে ২.৩৩ ডলার। ফুলকপির দাম ওঠানামা করছে ২-৩ ডলারে মধ্যে। কমের মধ্যে আছে টমেটো, যা আমাদের প্রায় প্রতি দিনের মেনুতেই থাকে সালাদের উপকরণ হিসেবে। পেঁয়াজের দামই তেমন ওঠা-নামা করেনা। এই হিসাব হলো সবচেয়ে কমদামী দোকান ফুড বেসিক-এর দাম হিসেবে। জেহার্স বা সোবিস-এর মতো গ্রোসারিতে ঢুকতেই সাহস হয়না।
তবে এখানে দ্রব্যমূল্য ওঠা-নামা করে। বাংলাদেশের মত দাম একবার বাড়লে আর কমে না এমন নয়। অটোমোবাইল গ্যাস-এর কথাই ধরা যাক। আমরা বলি পেট্রল। এক সপ্তাহ আগেও ছিল লিটার প্রতি ৯০ সেন্ট (প্রায় ৫৫ টাকা)। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৬ সেন্ট (প্রায় ৬৩ টাকা)। উল্লেখ্য যে এখানে পেট্রলের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। সামার ড্রাইভিং সিজন তো এখনো শুরুই হয়নি। দাম যে কোথায় গিয়ে থামবে সেটাই দেখার বিষয়। অবস্থা এমন যে তেল খরচ বাঁচানোর জন্য নিতান্ত দরকার না হলে কোথাও যাই না। যাতায়াত কেবল ইউনিভার্সিটি আর গ্রোসারিতেই সীমাবদ্ধ। এর মধ্য কলেজের বন্ধু এবং একই ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংএর পিএইডি গবেষক মুরসালিন যখন প্রস্তাব দিল আলমাইরা ম্যাপল সিরাপ ফেস্টিভাল (Elmira Maple Syrup Festival) -এ যাওয়ার জন্য তখন আর না বলতে পারলাম না। ম্যাপল সিরাপ ফেস্টিভাল কানাডার বসন্ত বরণ উৎসব যা পালিত হয় ১ এপৃল – এক দিনের জন্য। বসন্তকাল সব সময়ই আমার কাছে একটু আলাদা। আর তাই প্রস্তাব মাত্রই রাজী হলাম। কানাডায় নতুন ড্রাইভ করছি। এখনো ফৃওয়েতে ড্রাইভ করার অভিজ্ঞতা হয়নি। ফৃওয়ে হচ্ছে হাই-স্পীড হাইওয়ে যেখানে অনুমোদিত গতিসীমা প্রতি ঘন্টায় ৯০ থেকে ১০০ কি.মি.। অন্য কোন সময় হলে হয়তো মুরসালিন-এর সাথেই যেতাম, কিন্তু এই সুযোগে ফৃওয়ে ড্রাইভিং এর প্রথম স্বাদ নেয়ার কৌতূহল আর দমাতে পারলাম না। তাই ঠিক হল যার যার মতো ড্রাইভ করে বসন্ত উৎসবে যোগ দিব। মেঘলা সকালে আমি, সহধর্মিনী রিফা ও দুই বছরের মেয়ে তাসফিয়া এক গাড়িতে এবং মুরসালিন ও জ্যোতি ভাবী তাদের গাড়িতে রওনা হলাম।
উৎসবে পোঁছুতে ২০ কিলোমিটার পথ যা ১৫ মিনিটেই পাড়ি দেয়ার কথা তা বুঝি আর শেষ হয়না। ইউনিভার্সিটি এভিনিউ থেকে হাইওয়ে ৮৫ নর্থ ধরে খানিকটা এগোতেই বিশাল জ্যাম। সবাই যেন আজ এই ফেস্টিভালে যাচ্ছে। আর তাই হাইওয়ে ধরে এই বিশাল গাড়ির বহর যা ঈদের সময় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গাড়ি-জটের কথা মনে করিয়ে দিল। আমার ফৃওয়ে ড্রাইভিংএর আশাও পূরণ হল না। অতি ধীরে এগুই আর রাস্তার দুইপাশে চোখ বুলাই। বিশাল প্রান্তর নতুন করে ফসল লাগানোর জন্য প্রস্তত করা হচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ল পত্রবিহীন ম্যাপল বাগান। ক্যালেন্ডারের হিসেবে শীতকাল প্রায় শেষ। কিছুদিন পরই এই বাগানগুলোই ভরে উঠবে সবুজের সমারোহে। ম্যাপল শাখায় ফিরে আসবে প্রাণ। শম্বুক গতিতে চলে প্রায় ৪০ মিনিট পর আলমাইরা পৌঁছুলাম। রাস্তার দু’পাশে মাঝে মাঝেই ঘোড়া টানা গাড়ি চোখে পড়ল। ঘোড়া গুলো রাস্তার পাশে বেঁধে গাড়ির উপর কালো পোষাক পড়া বিক্রেতা ম্যাপল সিরাপের পসরা নিয়ে বসে আছে। ৪ লিটারের দাম ৩৫ ডলার। একেবারে কম নয়। অনেকেই গাড়ি রাস্তার পাশে থামিয়ে ম্যাপল সিরাপ কিনছে। ম্যাপল সিরাপ হল ম্যাপল গাছের রস। অনেকটা আমাদের দেশে খেজুর রসের মত সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে বিশেষ প্রকৃয়ায় ঘন করা এক ধরনে সিরাপ। দেখতে মধুর মত তবে আর একটু পাতলা। ভীষণ মিষ্টি। উৎসবের প্রধান আকর্ষণ– এই ম্যাপল সিরাপ দিয়ে প্যানকেক খাওয়া। প্যানকেক এক ধরনের পিঠা যা আমাদের দেশের চিতই পিঠার মত করে তৈরী করা হয়। মূল উৎসবস্থলে রাস্তার উপর নানা ধরনের খাবারের দোকান রয়েছে যার মধ্যে ম্যাপল সিরাপের দোকানই বেশী। এছাড়াও আছে টার্কিশ গাইরস আর সামোসার দোকান, সৌখিন জিনিস, কাঠ দিয়ে তৈরী ঘর সাজানোর উপকরণ আর ছোট বাচ্চাদের মজার মজার খেলনার দোকান। উৎসবস্থলের দু্ই প্রবেশ পথে রয়েছে তথ্যকেন্দ্র। সেখান থেকে আগত দর্শকদের দেয়া হচ্ছে তথ্য নির্দেশিকা আর উৎসবের ম্যাপ।
এবার খানিকটা অতীতে ঘুরে আসা যাক। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় লরেন্স ও গ্রেট লেকের (Lawrence and Grate Lakes) অধিবাসী প্রথম জাতিগোষ্ঠী (First nations people) ইউরোপীয়রা আসার অনেক আগেই ম্যাপল সিরাপ ব্যবহার করত। ১৬৮৫ সনের বৃটিশ রয়্যাল সোসাইটির এক পত্রে ম্যাপল সিরাপের বর্ণনা পাওয়া যায়। কয়েক শতাব্দী ধরে চালু এই শিল্প উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো সময়ই সমৃদ্ধশালী থাকে। এসময়ে আমদানিকৃত চিনির শুল্ক ও উচ্চ মূল্যের জন্য কানাডা ও আমেরিকায় ম্যাপল সিরাপ এবং ম্যাপল থেকে প্রস্তত চিনির ব্যাপক ব্যবহারের কথা জানা যায়। অতপর বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এই শিল্পে স্থবিরতা দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালের কথা। আলমাইরা বোর্ড অব ট্রেড উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উদ্যোক্তার অভাব আর উৎসাহের কমতি লক্ষ্য করে সংগঠনই ভেঙে দেওয়ার চিন্তা শুরু করে। আর তখনই হার্ব এইনস্ওয়ার্থ (Herb Ainsworth) নামের এক ফল ও মূদী ব্যবসায়ী ম্যাপল শিল্পের স্বার্থে ম্যাপল সিরাপ ফেস্টিভালের প্রস্তাব করেন। তার সাথে সুর মেলায় আরো কয়েকজন দুরদর্শী বনিক। ফলশ্রুতিতে সেই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারী বোর্ড মিটিংএ তৎকালীন সেক্রেটারি এলডন হফার (Eldon Hoffer) এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক হয় ১০ এপ্রিল ১৯৬৫ হবে প্রথম ম্যাপল সিরাপ ফেস্টিভাল। এরপর আলমাইরা বোর্ড অব ট্রেডকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নব উদ্যমে যাত্রা শুরু করে ম্যাপল শিল্প। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যার উদ্যোগ ও দূরদর্শী চিন্তার ফসল এই উৎসব, সেই এইনস্ওয়ার্থ উৎসব উদ্বোধনের এক সপ্তাহ আগে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হার্ট আ্যটাকে মারা যান।
এর পর প্রতিব্ছর ধরে চালু রয়েছে এই উৎসব। উৎসবের মূল সূর প্রতি বছর একই – “আসুন, আস্বাদন করুন ঐতিহ্য”। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে এক দিনের এই আনন্দে যোগ দিতে। ২০০০ সালে ৬৬,৫২৯ জন দর্শনার্থীর আগমনে আলমাইরা ম্যাপল উৎসব গিনেজ বুকে স্থান করে নেয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একদিনের ম্যাপল সিরাপ উৎসব হিসেবে। মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুরে প্রায় দ্বিগুন দামে টার্কিশ দোকানের হালাল গাইরস (Gyros) খেয়ে কাটিয়ে দিলাম দুই ঘন্টা। ক্যামেরায় বন্দী করলাম উৎসবের ছবি। পরিবার নিয়ে এসেছি তবুও দুষ্ট লোকের ভয় নেই, পকেটমার হওয়ার চিন্তা নেই; সবাই যার যার মত আনন্দে ভাসছে নির্বিঘ্ন এই জনারন্যে। কিন্তু এতকিছুর পরেও আমার কেবলই মনে পড়ছিল রমনার পহেলা বৈশাখের উৎসবের কথা। বৈশাখী মেলার আনন্দের সাথে না হয় এর তুলনা না কখনো সে তুলনা সম্ভব।
ফেরার পথ ১০ মিনিটেই শেষ হল। প্রবাসে জীবন কেবল নিজের পরিবার অফিস আর পরিবারের মধ্যেই বন্দী। নেই বাবা-মা আত্নীয়-স্বজন, নেই আড্ডা, নেই দশজন মিলে অহেতুক সময় নষ্ট করার আনন্দ। এখানে সবাই যে যার মত ব্যস্ত। মাঝে মাঝে দুই একটা গেটটুগেদার আর ঘুরে বেড়ানো ছাড়া জীবন এখানে জানালাবিহীন চৌকোনা ঘরের মত বদ্ধ, একমূখী আর বৈচিত্রহীন। পহেলা বৈশাখ এখানে আসেনা। বৈশাখী মেলায় তিন টাকা দামের বেহালার সুরও এখানে বাজে না। এমন ফেস্টিভালে যাওয়ার আনন্দ তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতই। সেটাই বা কম কিসের।
শেষ।
No comments:
Post a Comment