2011/10/23

হারিয়ে যাওয়া শিমুল ও অন্যান্য

২০১১/২/১১ শুক্রবার

যাযাবরের মত সপ্তাহটা কেটে গেল। দক্ষিণে দুইদিনের সফর শেষে ঘরে একরাত কাটিয়ে আবার উত্তরের পথে যাত্রা। এবার গন্তব্য টরন্টো। টরন্টোর কথা মনে হলেই টরন্টোতে প্রথমদিন ড্রাইভ করার স্মৃতি মনে পড়ে। দুই ঘন্টা ধরে ঘুরেও যখন গন্তব্যে পৌঁছুতে পারছিলাম না তখন হাতের কাছে যে রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল সেখানেই ক্ষুধা মেটানো হয়েছিল। এমন নয় যে গন্তব্য অচেনা ছিল। সমস্যা ছিল--এই লেনে বাঁয়ে মোড় নেয়া যাবেনা তো সেই লেনে অবশ্যই ডানে মোড় নিতে হবে। এরপর কয়েকবার গিয়েছি, অবশ্যই জিপিএস সহ। সেই থেকে টরন্টো আমার কাছে আঙ্গুর ফল টক--এর মত।

এবার অফিসিয়াল কাজে যাবো, তাই রিস্ক নিলাম না। কর্পোরেট গাড়ি বুকিং দেয়া থাকলেও শেষ মুহূর্তে ড্রাইভ করতে মন চাইলো না। সিদ্ধান্ত পালটে ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম। ভিয়া রেইলে (VIA Rail) আরাম করে যাওয়ার সুযোগ ফেলে ৫ ঘন্টা ধরে ড্রাইভ করার কোন মানেই হয়না। ভিয়ায় বসে ওয়াই-ফাই দিয়ে সচলায়তনে জমে থাকা কয়েকটা পোস্ট পড়ে ফেললাম। আর তখনই শিমুলের কথা মনে পড়ল।

শিমুল হারিয়ে গেছে। কাছে থেকেও অনেক দূরে অমিত আর বিপ্র। দূরে চলে গেছে কিংকু। অথচ চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই এমভি জিমান-এ একসাথে ভ্রমণের স্মৃতি।

বৃহস্পতিবারে কাজ শেষ হয়ে গেল ৩টার সময়। বাকী সময় কিভাবে কাটাই সেই চিন্তা করতে করতে অমিতকে মেইল দিলাম। অমিত আসলে ভালোই হবে। অন্তত কোথায় ভালো খাবারের দোকান আছে সেটা জানা যাবে। মোবাইল দিয়ে গুগল ম্যাপে কয়েকটা পেয়েছি, কিন্তু টরন্টোতে এত্ত ঠাণ্ডা! দশ মিনিট হাঁটলেই মনে হয় পা জমে যাচ্ছে।  অমিত আসবে সেই আশায় দুপুরে কিছুই খাইনি--এক সাথে খাব বলে। কিন্তু ফিরতি মেইলে অমিত জানালো আজ আসতে পারবেনা। পরদিন (শুক্রবার) আসবে। কী আর করা, গুগলে দেখলাম ৯৯ জেরার্ড স্ট্রিটে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। হেঁটে ইয়ঞ্জ থেকে জেরার্ড-এ পড়তেই ভুলটা বুঝতে পারলাম। ইস্ট না ওয়েস্ট সেটা দেখা হয়নি। ঠাণ্ডা এত বেশী যে গ্ল্যাভস খুলে মোবাইলে দেখে নেব সেই ইচ্ছাটাও মাটি চাপা দিলাম। ইস্টেই হাঁটা ধরলাম। তিন-চার মিনিট পরে ইউনিভার্সিটির মেইন এন্ট্রাস। আরে এটা তো শিমুলের ইউনিভার্সিটি! এখানেই শিমুল একদিন পড়তে আসতো। ইশ্ শিমুল থাকলে কী না ভাল হতো! আরো কিছুদূর হাঁটার পর ৯৯ জেরার্ড পেলাম। কিন্তু ক্ষুধার্ত পেটে ৯৯ জেরার্ড ইস্টে ইউনিভার্সিটির কোন বিল্ডিং আমি অবশ্যই আশা করিনি। একেই বলে কপাল। রেস্টুরেন্ট নিশ্চয়ই ওয়েস্টে হবে। যেতে হলে অন্তত ২০ মিনিট হাঁটতে হবে। শিমুল থাকলে এই ভুলটা নিশ্চয়ই হতো না। শিমুল, তুমি না বলেছিলে আবার আসবে? তুমি কিভাবে হারিয়ে গেলে শিমুল?

শুক্রবার বিকালে হোটেলের স্টোরেজ থেকে ব্যাগ বুঝে নেই। সকালেই চেকআউট করেছি। লবিতে বসে সময় কাটাই। অমিত অনেক দূরে থাকে। আসতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগবে। এত কষ্ট করে আসবে ভাবতেই খারাপ লাগলো। ইয়ঞ্জ আর ব্লর ইন্টারসেকশনে সাবওয়ে স্টেশনের বাইরে অমিতের সাথে দেখা হলো। অমিতের শহরে অমিতের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম।

আমার আবার খাবারের বাতিক আছে। হালাল খাব, নয়তো ভেজিটেরিয়ান। অমিতের শহরে এসেছি, এই শহর তার হাতের তালুর মত চেনা। টুকটাক গল্প করতে করতে আমরা একটা রেস্টুরেন্টে হাজির হই। মজার বিষয় হলো খাবার সার্ভ করে দেশী স্টাইলে। প্লেটে ভাত তুলে কী কী নেব সেটা বলে দিলে আইটেমগুলো সাজিয়ে তুলে দেয়। আরো মজার বিষয় হলো, বিল দিতে হবে খাওয়ার পরে।

আবার শিমুলের প্রসঙ্গ চলে আসে। অমিতের সামনে বারবার শিমুল শিমুল করছিলাম দেখে মাঝে মাঝে নিজেরই অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু আমি জানি, শিমুলের লেখা আমি যেমন পছন্দ করি, তেমনি পছন্দ করে অমিত। শিমুল দেশে আছে, ফেসবুকে আছে, সম্ভবত ভালো আছে, এবং নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে। প্রসঙ্গ ঘুরে সচলায়তনে আসি। আলোচনা হয়, চিন্তা হয়, ভবিষ্যতের কথা হয়। হিমুর কথা হয়, আরো কার কার যেন কথা হয়। নতুন খোলা ব্লগ-সাইট নিয়ে কথা হয়, অধিকাংশ ব্লগেই যা খুশি তাই (কিংবা যাচ্ছেতাই) লেখা হচ্ছ-- সেসব নিয়ে কথা হয়।

গল্পে গল্পে সাড়ে ছয়টা বেজে যায়। অমিত কাশ্মীরী চা'র অর্ডার দেয়। আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। হাতে ২০ মিনিট রেখে অমিতকে বলি, অমিত ট্রেন ৭টায়। অমিত বলে, 'কোন সমস্যা নেই, আপনাকে ইউনিয়ন স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসবো'। আমি বলি, 'ট্রেন মিস করলে কিন্তু নিজের পয়সা দিয়ে টিকিট কাটতে হবে, আর থাকার খরচও পকেট থেকে দিতে হবে।' অমিত অভয় দেয়, 'থাকা নিয়ে সমস্যা হবে না।'

কাশ্মীরী চা-এ এক চুমুক দিয়েই বুঝতে পরি এই চা না খেলে টরন্টো ট্রিপই বৃথা হয়ে যেত। আয়েশ করে খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সময় তো আয়েশ করতে জানে না।

আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

একটু পরেই অমিতকে রেখে চলে যেতে হবে, ভাবতেই খারাপ লাগছিল। সাবওয়ের বাড়তি তিনটা কয়েন অমিতকে দিতে চাইলাম, ও নিলো না। বললো, 'রেখে দেন, টরন্টো এলে কাজে লাগবে'। আমি জোর করলাম না।

গেট নাম্বার ২৫-এ বোর্ডিং হবে। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। 'অমিত, তুমি চলে যাও'। ও গেল না। অনেক কথা হলো। এক সময় অমিতকে রেখে আমি ট্রেনে উঠে গেলাম।

পাখি উড়ে যায়, ফেলে যায় তার পালক। বাসায় ফিরে শিমুলের ফেলে যাওয়া ক্যাপটা আবারো দেখলাম। কিংকু মাঝে মাঝে ছবি পোস্ট করে ফ্লিকারে। কয়দিন আগে লন্ডনে গিয়েছিলাম, বিপ্রর সাথে ফোনে কথা হয়েছে। সময় কত দ্রুত চলে যায়! স্মৃতিগুলোই কেবল রয়ে যায় আগের মতো।

No comments:

Post a Comment