2007/12/18
ঘুঘু সমাচার
সারাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়
।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।। ডিসেম্বর ১৬, ২০০৭।
জাতীয় গ্রীডের সৃষ্ট ত্রুটির কারণে গতকাল শনিবার দুপুর পৌনে বারোটায় দেশের সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সারা দেশ প্রায় তিন ঘন্টারও বেশি সময় ছিল পুরোপুরি বিদ্যুৎবিহীন। বিপর্যয়ের আট ঘন্টাতেও দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। রাত মেঘনাঘাট সাড়ে ৪০০, হরিপুর ৩৬০, ঘোড়াশাল ২১০ মেগাওয়াট ইউনিট চালু করা সম্ভব হয়েছে। গতকালের এ বিপর্যয়ের কারণে এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য সারা দেশ হয়ে যায় বিদ্যুৎবিহীন। জনজীবনে নেমে আসে ছন্দ পতন। বিপর্যয়ের কারণে বঙ্গ ভবন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, বাসভবন, সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত দু’টি বিশেষ কারাগারসহ সকল স্থান ছিল বিদ্যুৎবিহীন।
দুপুর পৌনে বারোটায় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৩২ কেভি বিদ্যুৎ সাব স্টেশনে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পরই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সবকটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাবার পরপরই দেশের চালু সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে এই বিপর্যয়ের জন্য আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দায়ী করা হলেও, আশুগঞ্জ পাওয়ার কোম্পানির কর্মকর্তারা বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন ত্রুটি হয়নি। ত্রুটি হয়েছে জাতীয় গ্রীডের অন্য কোন স্থানে। অবশ্য ত্রুটি খুঁজতে পিডিবির সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডি কে পোদ্দার ও কয়েকজন প্রকৌশলীকে তাৎক্ষণিকভাবে আশুগঞ্জে পাঠানো হয়েছে। দুপুর পৌনে বারোটায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবার পর দুপুর দুইটার দিকে ঢাকায় মাত্র ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বঙ্গ ভবন, প্রধান উপদেষ্টার অফিসসহ কয়েকটি স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয়। এরপর আস্তে আস্তে ঢাকায় অবস্থিত ডেসা কন্ট্রোল রুমের বিদ্যুৎ প্রাপ্তির মিটার একটু একটু করে বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয় আড়াইশ মেগাওয়াট। রাত আটটায় ঢাকায় সরবরাহ দেয়া হয় ৫০০ মেগাওয়াট। এবং সারা দেশে সরবরাহ দেয়া হয় ১৩০০ মেগাওয়াট। এখানে উল্লেখ্য, কেবল ঢাকায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় সর্বনিম্ন ১৫০০ মেগাওয়াট। গ্রীড লাইন ট্রিপ করার পরই মাঠে নেমে পড়েন বিদ্যুৎ বিভাগ, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার গ্রীড কোম্পানি অফ বাংলাদেশের কর্মকর্তা এবং প্রকৌশলীরা। ঢাকায় বিদ্যুৎ সচিব ড. ফাওজুল কবির খান ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারে পুরো অপারেশন মনিটর করেন। তিনি অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানান, এ বিপর্যয় রোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। সোয়া বারোটার দিকে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়। এরপর আশুগঞ্জের একটি ছোট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে কয়েক দফা চেষ্টা চালিয়ে এর উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা হয়। দুপুর তিনটা নাগাদ রংপুর, সৈয়দপুর, সিলেট, শাহজীবাজার, বাঘাবাড়ি, ভেড়ামারা এবং ময়মনসিংহ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করা হয়। ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুৎ দিয়ে বিকেল তিনটা নাগাদ ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, মেঘনাঘাট, হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর চেষ্টা করা হয়।
আশুগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, জাতীয় গ্রীড লাইনে বিপর্যয়ের পর শনিবার দুপুর পৌনে ১২টায় হঠাৎ একটি বিকট শব্দ হয়ে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবকটি ইউনিটে একযোগে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ৭২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন অত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন নেমে আসে শূন্যের কোটায়। গ্রীড লাইনে বিপর্যয়ের আগে অত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চালুকৃত ৫টি ইউনিটে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল। বিপর্যয়ের প্রায় ৩ ঘণ্টা পর ময়মনসিংহ ও শাহজিবাজার থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ এনে অত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন জিটি-২ ইউনিটটি চালু করা সক্ষম হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান খান জানান, জাতীয় গ্রীড লাইনে কোথায় ত্রুটি হয়েছে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আবদুল খালেককে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন করে একাধিক ছোট-খাটো ত্রুটি দেখা দেয়ার কারণে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন চালু করতে বিপদ হচ্ছে। তবে রাতের মধ্যে সচল ইউনিটগুলো চালু হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে একটি সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৩২ কেভি লাইনে একটি ঘুঘু পাখির আঘাতে বিকট শব্দ হয়ে ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং জাতীয় গ্রীড লাইন বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। দুপুর ১২টা থেকে একবার চেষ্টা চালিয়ে জিটি-২ ইউনিটটি বিকেল ৩টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। রেক্টিফায়ার ত্রুটির কারণে তার বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না।
পলাশ সংবাদদাতা জানান, জাতীয় গ্রীডে বিপর্যয়ের কারণে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পৌনে বারোটায় বন্ধ হয়ে যায়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সাড়ে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল খালেক জানিয়েছেন, তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বিদ্যুৎ চলে যাবার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জেনারেটরের সাহায্যে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। মেডিক্যালের নাক কান গলা বিভাগে জেনারেটর সংযোগ না থাকায় একটি অপারেশন হয়েছে মোমবাতি জ্বালিয়েই।
দুপুর পৌনে বারোটায় বিদ্যুৎ গ্রীডে বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সকল ট্রাফিক সিগন্যাল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। ট্রাফিক পুলিশদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বেগ পোহাতে হয় দিনে এবং রাতে। ব্যারাক থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে।
হঠাৎ করে এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনেও ছিল একই অবস্থা। যেসব সিএনজি স্টেশন জেনারেটর চালিত সেগুলোতে পড়ে যায় দীর্ঘ লাইন। শনিবারে খোলা থাকে এমন সব অফিসে কাজ হয়েছে অনেক কষ্টে। বহুতল অধিকাংশ ভবনে জেনারেটর চালিত লিফটগুলো কিছুক্ষণ চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁও এর বিভিন্ন কাজ চলেছে মোমবাতি জ্বালিয়ে। অসহনীয় ছিল এই অবস্থা।
সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গে মুদির দোকানগুলোতে মোমবাতি কেনার জন্য বেরিয়ে পড়েন অনেকে। ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় সন্ধ্যায় দোকানদাররা বেচাকেনা করেছেন হারিকেন, চার্জার লাইট কিংবা মোমবাতির আলোতে।
রংপুর থেকে ওয়াদদু আলী জানান, গতকাল শনিবার উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা দীর্ঘ ৫ ঘন্টা বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত থাকে। সকাল ১১টা ৪২ মিনিটে আকস্মিকভাবে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর বিকেল ৫টার দিকে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তাও প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য। রংপুরে চাহিদার ১৮ মেগাওয়াটের বিপরীতে মাত্র ৩ মেগাওয়াট দেয়া হয়। দীর্ঘ ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়ে। হাসপাতাল ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হয়। তবে বিকেল ৪টার দিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অফিসগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ রিপোর্ট পাঠানোর সময় পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
সেনবাগ সংবাদদাতা জানান, গতকাল শনিবার নোয়াখালীর সেনবাগে পল্লী বিদ্যুতের বিতরণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সেনবাগ জোনাল অফিসের ডিজিএম নূর মোহাম্মদ আজম জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ ফেনী-নোয়াখালী ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জাতীয় গ্রীড লাইনে বিপর্যয়ের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বলে তারা জানতে পারেন।
গতরাত সাতটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকায় শহর এবং গ্রামাঞ্চলের সবখানে বিদ্যুৎহীন ভূতুড়ে পরিবেশ নেমে আসে।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, জাতীয় গ্রীডের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামেও। গতকাল টানা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে চট্টগ্রামের সাড়ে ৫শ’ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ ভারি ও মাঝারি প্রায় সব শিল্পের উৎপাদনে ধস নামে। জনজীবনে পানি সংকটসহ অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জাতীয় গ্রীড লাইন বিপর্যয়ের কারণে চট্টগ্রামের ৩টি প্রধান বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলো টানা অচল হয়ে পড়ায় গ্যাস জ্বালানির জন্য এসব স্টেশনের সামনে শত শত যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।
পিডিবি’র জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানানো হয়, বিকেল ৩টা নাগাদ কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২টি ইউনিট চালু করা হলে সেখান থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মেলে। ফলে কেপিআইসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সীমিতভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। তবে নগরীর অধিকাংশ অঞ্চল ছিল অন্ধকারে। এখানে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল সাড়ে ৩শ’ মেগাওয়াটের ওপরে। গ্রীড লাইন বিপর্যয়ের কারণে রাউজান তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা ও কাপ্তাই কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে যায়।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি এমএ সালাম শনিবার সন্ধ্যায় ইত্তেফাককে জানান, সাড়ে ৫শ’ গার্মেন্টস কারখানার উৎপাদনে ভয়াবহ ধস নামে। কারখানাগুলোতে জেনারেটর দিয়ে কোনমতে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু উৎপাদন কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ।
----------------------------------------------------------------------
ঘুঘুই দায়ী ঃ আহতাবস্থায় আটক
।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।। ডিসেম্বর ১৭, ২০০৭
দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে। তবে গতকাল রবিবার বিজয় দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটির কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় রাজধানীতে লোডশেডিং কম হয়েছে। আজ থেকে অফিস আদালত, শিল্পকারখানা চালু হলে বিদ্যুতের লোডশেডিং হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ইউনিটগুলো চালু করতে দিনরাত কাজ করা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে বিদ্যুতের গ্রিড বিপর্যয়ের ঘটনা তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি গত শনিবারের গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৩২ কেভি ভাসবারে ফ্লাশিংকেই দায়ী করেছেন। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য একটি ঘুঘু পাখিকে দায়ী করা হয়েছে। বর্তমানে আহতাবস্থায় পাখিটিকে আশুগঞ্জে আটক করে খাঁচায় রাখা হয়েছে। বিদ্যুতের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, বিদ্যুতের সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে দ্রুত কোন কাজ করা যাবে না। তবে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তিনি জানান, ইতিমধ্যে দেশের সবকটি বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সচল অধিকাংশ ইউনিটগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
পিডিপি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত দেশে ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ৩ হাজার ৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। ফলে দেশের অল্প কয়েকটি স্থানে সন্ধ্যার পর সামান্য লোডশেডিং-এর ঘটনা ঘটেছে। ঘুঘুই দায়ী ঃ এদিকে আশুগঞ্জ থেকে ইত্তেফাকের সংবাদদাতা সেলিম পারভেজ জানান, জাতীয় গ্রিড লাইনে বিদ্যুতের মহা বিপর্যয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে সেই ঘুঘু পাখিকেই দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যেই অত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুইচ ইয়ার্ডের ভিতরে ঘটনাস্থল থেকে ঘুঘু পাখীটিকে উদ্ধার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোলরুমে প্রকৌশলীদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। পাখিটির পিছনের ডানা ও লেজের সবগুলো পাখনা বিদ্যুতের শর্টসার্কিটে পুড়ে গেলেও এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে। অফিসের একটি কাগজের ঝুড়িতে অপরাধীদের মত পাখিটিকে আটক রাখা হয়েছে। নির্বাক এই পাখিটি নড়াচড়া করলেও পাখনা না থাকায় উড়তে পারছে না।
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে আসা তদন্ত কমিটির প্রধান পিডিবির সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডিকে পোদ্দারও এই ঘুঘু পাখিটিকে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করে ছবি তুলে নিয়ে রবিবার বিকেলে ঢাকায় ফিরে গেছেন। স্থানীয় তদন্ত কমিটির প্রধান আবদুল খালেক জানান, এ পর্যন্ত তদন্তে জাতীয় গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের জন্য ঘুঘু পাখিটিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে পাখিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুইচ ইয়ার্ডের ১৩২ কেভি ভাসভারের জাম্পার ও হরনগেটের মধ্যদিয়ে যাওয়ার পথে ফ্লাশিং হয়ে বিকট শব্দে জাতীয় গ্রিড লাইনে মহাবিপর্যয় ঘটে। এ সময় পাখিটির পায়ে ঝুলিয়ে তার জাতীয় কোন জিনিস নিয়ে যাচ্ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা জাতীয় গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের পর গত শনিবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুইচ ইয়ার্ডে ১৩২ কেভি ভাসভারের কাছে ঐ পাখিটিকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এদিকে ঘুঘু পাখিটিই গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের জন্য দায়ী এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে অনেকটাই স্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে।
গত শনিবার দুপুর পৌনে ১০টায় গ্রিড লাইনে বিপর্যয় হয়ে দেশের সববিদ্যুৎ কেন্দ্রের চালুকৃত সব ইউনিটে এক যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
আশুগঞ্জ কেন্দ্রের অবস্থা
স্বাভাবিক হয়নি
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ছোট ৩টি ইউনিট চালু হয়েছে। ৭২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বর্তমানে মাত্র ১৫৪ মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বলেছেন, গ্রিড বিপর্যয়ের পর এ পর্যন্ত ৪টি ইউনিট চালু করা সম্ভব হলেও ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৪ নং ইউনিট গতকাল বেলা পৌনে ২ টায় ফের ট্রিপ করে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে চালুকৃত প্রতিটি ৬৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট ১ও ২ এবং ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জিটি-২ ও ৩টি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৫৪ মেগাওয়াট। বর্তমানে ৪ নং ইউনিটটি চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। সচল ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট ৩এ নতুন করে ত্রুটি দেখা দেয়ায় আপাতত চালু করা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জিটি ১ এবং ৩৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গত ১ মাস ধরে এবং ওভারহলিং কাজের জন্য ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ইউনিট ৫ গত দুই বছর ধরে বন্ধ আছে। ইউএনবি বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় আগামীকাল সকালের আগে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।
প্রসঙ্গ, জাতীয় গ্রীডের সৃষ্ট ত্রুটির কারণে শনিবার দুপুর পৌনে বারোটায় দেশের সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সারা দেশ প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ছিল পুরোপুরি বিদ্যুৎবিহীন। বিপর্যয়ের ৩৬ ঘণ্টা পরও দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
---------------------------------------
ঘুঘুটি পানি ছাড়া কিছুই খাচ্ছে না
বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ
।। সেলিম পারভেজ আশুগঞ্জ সংবাদদাতা ।। ইত্তেফাক ডিসেম্বর ১৮, ২০০৭
বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত ঘুঘু পাখিটি এখনো বেঁচে আছে। বর্তমানে আহত এই পাখিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কন্ট্রোলরুমে একটি কাগজের ঝুড়িতে বাস করছে। পাখিটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানান। গতকাল সোমবার ঘুঘু পাখিটিকে খাবার হিসাবে ধান, মুড়ি ও চিড়া দেয়া হয়েছে, পাশে রাখা হয়েছে পানিও। তবে পাখিটি গতকাল অন্যান্য দিনের ম ত এত নড়াচড়া করেনি। ঝুড়িতে আটক থাকা পাখিটি গলা নাড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। পাখিটি মুক্ত হতে চাইলেও পিছনে পাখনা না থাকায় উড়াল দিতে পারছে না। অসহায়ের মতো বন্দি পাখিটি কতদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে এই প্রশ্ন এখন কেন্দ্রের প্রকৌশলীদের।
পাখি বিশেষজ্ঞ শরীফ খান আহত ঘুঘুটিকে বাঁচাতে চালের খুদ, ধূলোমাটি, খোসাশুদ্ধ মসুরের ডাল অথবা সরিষা দানা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি আহত পাখিটি খাবার খায় তাহলে বেঁচে যাবে। আর না খেলে আরও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তিনি জানান, যদি কোন ক্ষত না থাকে তাহলে পুড়ে যাওয়া পালক ঝরে পড়ে নতুন পালক গজাবে। তবে সময় একটু বেশি লাগবে। তিনি জানান, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে এই প্রজাতির ঘুঘু বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটি রাজ ঘুঘু গোত্রের।
ঘুঘু দায়ী নয় ।। দুই কর্মকর্তা সাসপেন্ড
।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।। ডিসেম্বর ১৯, ২০০৭
সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি প্রধান পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এএনএম রিজওয়ান বলেছেন, গত ১৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে আরো তিন সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। তবে ঘুঘুর আঘাতে ট্রান্সমিশন লাইনে ত্রুটি এবং পুরো গ্রিড বিপর্যয়ের সন্দেহটি তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঘুঘুর আঘাতে এ ঘটনা ঘটেনি। অন্য কোন ত্রুটি ছিল।
গতকাল মঙ্গলবার সিডরের সময় দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বিপর্যয় বিষয়ে সরকার গঠিত কমিটি তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কমিটির প্রধান এএনএম রিজওয়ান বিদ্যুৎ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে এক ব্রিফিংয়ে সিডরের সময়ে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাবষ্টেশনগুলোর কাজের সমন্বয়হীনতা ও পুরানো বৈদ্যুতিক সঞ্চালন যন্ত্রপাতিকে দায়ী করা হয়। তিনি এ সমন্বয় বৃদ্ধি এবং মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন। ৮ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটিকে পরবর্তিকালে গত কয়েকদিন আগের গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানেরও দায়িত্ব দেয়া হয়। এজন্য কমিটি আরো তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট সংক্রান্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে কমিটি প্রধান এএনএম রিজওয়ান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঘুঘুর আঘাতে বিদ্যুৎ বিপর্যয় বিষয়টি ঠিক নয়। এটি বড় কোন পাখি যেমন বাজ হলে হয়তো সন্দেহটা ঠিক হতে পারতো। এক্ষেত্রে অন্য কোন কারণ রয়েছে, যা খুঁজে বের করা হবে।
এদিকে ১৫ ডিসেম্বরের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ী করে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
আশুগঞ্জ সংবাদদাতা জানায়, জাতীয় গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের তিন দিন পর মঙ্গলবার আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (সংরক্ষণ) জয়নাল আবেদীন খানকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে গঠিত ৩ সদস্যের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন গতকালও দাখিল করা সম্ভব হয়নি। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যবস্থায় আরো উন্নতি হয়েছে। চালু হয়েছে সবক’টি ইউনিট। ঘুঘুর উপর দোষ চাপিয়ে শেষ রক্ষা হবে কিনা তা নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সকল কর্মচারি-কর্মকর্তাদের মাঝে চরম আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারিগরি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল ভোর ৫টায় ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩নং ইউনিটটি চালু করা হয়। এ নিয়ে চালু ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫-এ। বর্তমানে এসব ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪শ’ মেগাওয়াট। এদিকে জাতীয় গ্রিড লাইনে বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানের জন্য স্থানীয়ভাবে গঠিত তদন্ত কমিটির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও ৪ দিনেও তা করা সম্ভব হয়নি। কমিটির প্রধান বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপ-মহাব্যবস্থাপক আব্দুল খালেক জানান, এ ব্যাপারে আরো তদন্ত প্রয়োজন। এছাড়া সাময়িক বন্ধ থাকা সক্রিয় ইউনিটগুলো চালু করার কাজে ব্যস্ত থাকায় যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশক্রমে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এক আদেশে অত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (সংরক্ষণ) জয়নাল আবেদীন খানকে গতকাল দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে শুধু দায়িত্বে অবহেলা নয়, সরকারি গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে।
ইত্তেফাক ডিসেম্বর ১৯, ২০০৭
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment