2007/08/12

এ্যাম্বাসেডর

আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
নো। আমি কৃত্রিমভাবে হেসে জবাব দেই।
দেন?
ইউ গেস।
প্যাকিস্টান?
নো।
শ্রী লাংকা?
নো।
হয়্যার আর ইউ ফ্রম দেন?

আমার মেজাজের পারদ সপ্তমে ওঠে। কিন্তু সেটা তো প্রকাশ করা যায়না। ঠান্ডা গলায় বলি

'আরন্ট দেয়ার এনি আদার প্লেসেস ইন সাউথ এই'শা?'

ও, ইউ'র ফ্রম নেপাল, রাইট?

মেজাজের পারদ এবার বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আগের চেয়ে ঠান্ডা গলায় ব্যঙ্গের সুরে বলি,

"রঅঙ। বাট ইউ'র ভেরি ক্লোজ; আ'ম ফ্রম বাংলাদেশ"।

ভাগ্য ভাল বাংলাদেশকে চিনতে তার কষ্ট হয়না। সে বলে, হ্যাঁ তোমাদের ওখানে তো এখন ভীষণ বন্যা।

বাংলাদেশ আর বন্যা, বাংলাদেশ আর সাইক্লোন, বাংলাদেশ আর গরীব দেশ; এগুলো এদের কাছে সমার্থক হয়ে গ্যাছে। সপ্তাহ খানেক আগে টরন্টো সান পত্রিকায় পাভেল রহমানের তোলা সিরাজগঞ্জে বন্যার ছবি ছাপা হল। তার কয়েকদিন পর টরন্টো স্টারের উইকএন্ডের পেপারে প্রথম পাতায় বন্যাপীড়িত এক মায়ের ছবি-- সন্তান কোলে নিয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে, রিলিফের আশায়।

খবর যখন পত্রিকার পাতায় ফলাও হচ্ছে তখন বাংলাদেশের কথা তো জানবেই। তারা জানবে বন্যায় ভেসে যাওয়া বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা কিভাবে যুগ-যুগ ধরে এই বন্যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গ্যাছে। তারা জানবে সাইক্লোনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা কী অসীম সাহসীকতা আর মনোবল দিয়ে এ ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। তারা জানবে আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষে ভরা বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের তৈরী পানি-আর্সেনিকমুক্ত করার যন্ত্র আবিস্কারের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে পরিচিত করার দায়িত্ব কাদের? আমরা যারা বিদেশে আছি, তাদের? বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের? দেশে যারা আছে তাদের? সার্বিকভাবে সবাই? উত্তরটা সহজে দেওয়া কঠিন।

লক্ষ্য করেছি, ভারতীয় চেহারার কারো সাথে দেখা হলেই হিন্দীতে কথা শুরু করে। আমি চুপ করে থাকি। একসময় বলি 'আই ডোন্ট স্পিক ইওর ল্যাংগুয়েজ'। কিছুটা তাচ্ছিল্লের স্বরে উল্টো জিজ্ঞেস করে, কোন ভাষায় কথা বলি। উত্তর শুনে অবাক হয়, বলে, কেন তোমরা তো হিন্দীও পারো; সাথে একটা রেফারেন্সও দেয়, অমুক বাংলাদেশী তো হিন্দীতেই কথা বলে। আমি আবারো বলি আমি হিন্দী বলতেও পারিনা, বুঝিও না। মনে মনে বলি, হিন্দী কোনদিন বুঝলেও স্বীকার করবনা, আর বলা তো অসম্ভব।

এখানে যত ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়েছি তার একটা বড় অংশই বাংলাদেশি পরিচালিত। অথচ এগুলোর নাম ইন্ডিয়া গার্ডেন, গেট অফ ইন্ডিয়া, সেহ্‌নাই কিংবা কোহ্-ই-নূর। ভেতরে হয়তো ছোট্ট একটা বাংলাদেশের ম্যাপ বা দেশের একটা শিল্পকর্ম। বেচে বাংলাদেশী খাবার অথচ বলে ইন্ডিয়ান কুইজিন। রিজিওন বোঝাতে ইন্ডিয়ান কুইজিন বলতে আমার আপত্তি নাই কিন্তু তাহলে বাংলাদেশের প্রচার হবে কী ভাবে?

দেশ ছাড়ার সময় আমার খুবই প্রিয় প্রবীন এক শিক্ষক বলেছিলেন বিদেশে গিয়ে তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন এ্যাম্বাসেডর। তাঁর কথা সবসময় মনে রাখি। চাল চলনে, মেজাজ মর্জিতে এই চামড়ার মান যাতে থাকে সেটাই চেস্টা। বাজে ভাবে কখনো গাড়ি চালাইনা, হাঁটার সময় সিগনাল না পড়লে ফাঁকা রাস্তাও পার হইনা; পাছে চামড়ার দূর্নাম হয়! কিন্তু যা কিছুই করছি লাভের গুড়তো যাচ্ছে 'ইন্ডিয়ার' ঘরে। আমারো যে একটা ভাষা আছে, নিজস্ব ভূখন্ড আছে, খাবারের ঐতিহ্য আছে সেটার প্রচারের দায়িত্ব তো আমারি। আমি স্বার্থপরের মত সে চেষ্টাই করে যাই।

প্রথম প্রকাশ: সচলায়তনে

No comments:

Post a Comment